বাংলায় সহজ ও সংক্ষিপ্ত উমরাহ হজ্জ সফর গাইড । করনীয় বর্জনীয় ধারাবাহিক আলোচনা

উমরাহ হজ প্রতিটি মুমিনের জীবনে পরম আরাধ্য এক স্বপ্নযাত্রা। প্রিয় নবীজির রওযা মোবারকে দুই রাকাত নফল নামাজ থেকে শুরু করে খানায়ে কা'বায় সালাতুল ইশা যেনো এক পার্থিব জীবনের অপার্থিব আনন্দমুহুর্ত। আজকে আমরা আলোচনা করবো পবিত্র উমরাহ হজের সফরকালীন যে মাসনুন দুআ, ধারাবাহিক কার্যপ্রণালী সহ যত করনীয় বর্জনীয় বিষয়গুলো একজন হাজির জানা একান্ত প্রয়োজন তার সবিস্তর।
উমরাহ সফরের ধারাবাহিক কার্যপ্রণালী:
১. উমরাহ এর ইহরাম (ফরজ)
পরিষ্কার-পচ্ছিন্নতা হয়ে গোসল বা অজু করে নিন। মিকাত অতিক্রমের আগেই সেলাইবিহীন একটি সাদা কাপড় পরিধান করুন, আরেকটি গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ইহরামের নিয়তে দুই রাকাত নামাজ পড়ে নিন।
উমরাহ এর নিয়ত করে এক বা তিনবার তালবিয়া পড়ে নিন। তালবিয়া হলো- ‘লাব্বাইকা আলাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাকা।
২. উমরাহ এর তাওয়াফ (ফরজ)
অজুর সঙ্গে ইজতিবাসহ তাওয়াফ করুন। ইহরামের চাদর কে ডান বগলের নিচের দিক থেকে পেঁচিয়ে এনে বাম কাঁধের ওপর রাখাকে ‘ইজতিবা’ বলে। হাজরে আসওয়াদকে সামনে রেখে তার বরাবর ডান পাশে দাঁড়ান (মেঝেতে সাদা মার্বেল পাথর আর ডান পাশে সবুজ বাতি)। এর পর দাঁড়িয়ে তওয়াফের নিয়ত করুন। প্রথম তিন চক্করে ‘রমল’ করুন। রমল হলো, বুক ফুলিয়ে বীর দর্পে হেটে চলা।
রুকনে ইয়ামানিকে সম্ভব হলে শুধু হাতে স্পর্শ করুন। তবে চুমু খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। এরপর হাজরে আসওয়াদ পর্যন্ত এসে চক্কর পুরো করুন।
পুনরায় হাজরে আসওয়াদ বরাবর দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে হাতের তালুতে চুমু খেয়ে দ্বিতীয় চক্কর শুরু করুন। এভাবে সাত চক্করে তাওয়াফ শেষ করুন।
হাতে সাত দানার তসবিহ অথবা গণনাযন্ত্র রাখতে পারেন। এতে সাত চক্করে ভুল হবে না।
৩. তওয়াফের দুই রাকাত নামাজ
মাকামে ইবরাহিমের পেছনে বা হারামের যে কোনো স্থানে তওয়াফের নিয়তে (মাকরুহ সময় ছাড়া) দুই রাকাত নামাজ পড়ে দোয়া করুন। মনে রাখবেন, এটা দোয়া কবুলের সময়।
৪. উমরাহ এর সায়ি’ (ওয়াজিব)
সাফা পাহাড়ের কিছুটা ওপরে উঠে (এখন আর পাহাড় নেই, মেঝেতে মার্বেল পাথর, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত) কাবা শরিফের দিকে মুখ করে সায়ি’র নিয়ত করে, দোয়ার মতো হাত তুলে তিনবার তাকবির বলে দোয়া করুন। তারপর মারওয়ার দিকে রওনা হয়ে দুই সবুজ দাগের মধ্যে একটু দ্রুত পথ চলে মারওয়ায় পৌঁছলে এক চক্কর পূর্ণ হলো। মারওয়া পাহাড়ে উঠে কাবা শরিফের দিকে মুখ করে দোয়ার মতো হাত তুলে তাকবির পড়ুন এবং আগের মতো চলে সেখান থেকে সাফায় পৌঁছলে দ্বিতীয় চক্কর পূর্ণ হলো। এভাবে সপ্তম চক্করে মারওয়ায় গিয়ে সায়ি’ শেষ করে দোয়া করুন।
৫. হলক করা (ওয়াজিব)
পুরুষ হলে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ অনুসরণে সম্পূর্ণ মাথা মুণ্ডন করবেন, তবে মাথার চুল ছাঁটতেও পারেন। মহিলা হলে চুলের মাথা এক ইঞ্চি পরিমাণ কাটবেন।
হজ সফরের ধারাবাহিক কার্যপ্রণালী:
১. হজের ইহরাম (ফরজ)
হারাম শরিফ বা বাসা থেকে আগের নিয়মে শুধু হজের নিয়তে ইহরাম বেঁধে ৮ জিলহজ যোহরের আগেই মিনায় পৌঁছে যাবেন।
২.আরাফাতের ময়দানে অবস্থান (ফরজ)
আরাফাতের ময়দানে অবস্থান হজের অন্যতম ফরজ। ৯ জিলহজ দুপুরের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করুন। এদিন নিজ তাঁবুতে যোহর ও আসরের নামাজ স্ব-স্ব সময়ে আলাদাভাবে আদায় করুন। মাগরিবের নামাজ না পড়ে মুজদালিফার দিকে রওনা হোন।
৩. মিনায় অবস্থান (সুন্নত)
জিলহজের ৮ তারিখ যোহর থেকে ৯ জিলহজ ফজরসহ মোট পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মিনায় আদায় করুন এবং এ সময়ে মিনায় অবস্থান করুন।
৪. মুজদালিফায় অবস্থান (সুন্নত)
আরাফায় সূর্যাস্তের পর মুজদালিফায় গিয়ে এশার সময়ে মাগরিব ও এশা এক আজান ও এক ইকামতে একসঙ্গে আদায় করুন। এখানেই রাত যাপন করুন (এটি সুন্নত) এবং ১০ জিলহজ ফজরের পর সূর্যোদয়ের আগে কিছু সময় মুজদালিফায় অবশ্যই অবস্থান করুন (এটি ওয়াজিব)। তবে দুর্বল (অপারগ) ও নারীদের বেলায় এটা অপরিহার্য নয়। রাতে ছোট ছোট ছোলার দানার মতো ৭০টি কঙ্কর সংগ্রহ করুন। মুজদালিফায় কঙ্কর খুব সহজেই পেয়ে যাবেন।
৫. কঙ্কর নিক্ষেপ (প্রথম দিন)
১০ জিলহজ ফজর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত শুধু বড় জামারাকে (বড় শয়তান) সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করুন (ওয়াজিব)। এ সময়ে সম্ভব না হলে এ রাতের শেষ পর্যন্ত কঙ্কর মারতে পারেন। দুর্বল ও নারীদের জন্য রাতেই কঙ্কর মারা উত্তম ও নিরাপদ। কঙ্কর মারার স্থানে বাংলা ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়; তা মনোযোগ দিয়ে শুনুন এবং মেনে চলুন।
৬. কুরবানি করা (ওয়াজিব)
১০ জিলহজ নিক্ষেপের পরই কেবল কুরবানি নিশ্চিত পন্থায় আদায় করুন। কুরবানির পরেই কেবল হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণে মাথা হলক করুন (ওয়াজিব)।
খেয়াল রাখবেন, কঙ্কর নিক্ষেপ, কুরবানি করা ও চুল কাটার মধ্যে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা জরুরি এবং ওয়াজিব। অন্যথায় দম বা কাফফারা দিয়ে হজ শুদ্ধ করতে হবে।
৭. তাওয়াফে জিয়ারত (ফরজ)
জিলহজের ১২ তারিখ সূর্যাস্তের আগেই তাওয়াফে জিয়ারত করে নিতে হবে। তা না হলে ১২ জিলহজের পরে তাওয়াফটি করে দম দিতে হবে। তবে নারীরা প্রাকৃতিক কারণে করতে না পারলে পবিত্র হওয়ার পরে করবেন।
৮. কঙ্কর মারা (ওয়াজিব)
জিলহজের ১১ ও ১২ তারিখে কঙ্কর মারা (ওয়াজিব)। ১১-১২ জিলহজ দুপুর থেকে সময় শুরু হয়। ভিড় এড়াতে আসরের পর অথবা আপনার সুবিধাজনক সময়ে সাতটি করে কঙ্কর মারবেন। প্রথমে ছোট, মধ্যম, তারপর বড় শয়তানকে। ছোট জামারা থেকে শুরু করে বড় জামারায় শেষ করুন। সম্ভব না হলে শেষরাত পর্যন্ত মারতে পারেন। দুর্বল ও নারীদের জন্য রাতেই নিরাপদ।
৯. মিনা ত্যাগ
১৩ জিলহজ মিনায় না থাকতে চাইলে ১২ জিলহজ সন্ধ্যার আগে অথবা সন্ধ্যার পর ভোর হওয়ার আগে মিনা ত্যাগ করুন। সূর্যাস্তের আগে মিনা ত্যাগ করতেই হবে- এটা ঠিক নয়। তবে সূর্যাস্তের আগে মিনা ত্যাগ করা উত্তম।
১০. বিদায়ী তাওয়াফ (ওয়াজিব)
বাংলাদেশ থেকে আগত হজযাত্রীদের হজ শেষে বিদায়ী তাওয়াফ করতে হয় (ওয়াজিব)। তবে হজ শেষে যে কোনো নফল তাওয়াফই বিদায়ী তাওয়াফে পরিণত হয়ে যায়। নারীদের মাসিকের কারণে বিদায়ী তাওয়াফ করতে না পারলে কোনো ক্ষতি নেই; দম বা কাফফারাও দিতে হয় না।